Headlines
Loading...
এ কে এম আব্দুল্লাহ’র গল্প: বিধবা খুশবু

এ কে এম আব্দুল্লাহ’র গল্প: বিধবা খুশবু



                           গল্প: বিধবা খুশবু

                         এ কে এম আব্দুল্লাহ


রোজিনা আজকাল খুবই ব্যাস্ত। আগে দু-তিনবাড়িতে কাজ করত। ইদানীং আরও কিছু বাড়িতেও কাজ করতে শুরু করেছে দুপয়সা বেশি আয়ের জন ̈। সামনেই ঈদ। আর মাত্র সাপ্তাহ খানেক বাকি আছে। গত ঈদে টাকার অভাবে রেহানকে নুতন জামা কিনে দিতে পারেনি। ভালো কিছু খাওয়াতে পারেনি। বাপমরা একমাত্র সন্তান রেহান। বয়স মাত্র পাঁচ। অনেক কান্নাকাটি করেছে। গতবছর রোজিনা অনেক অসুস্থ ছিল। জন্ডিস হয়েছিল।দুর্বল শরীর নিয়ে কাজকর্ম তেমন করতে পারেনি। টাকা জমাতে পারেনি। ছেলেকে কথা দিয়েছে এবারের ঈদে নুতন শার্ট-পেন্ট কিনে দেবে। চুলো থেকে উড়বে সেমাই খুশবু। সেই জন্য টেনেটুনে সংসারের খরছ শেষে দশ বিশটাকা একটি বৈয়ামে জমা করে রাখছে।

আজ নির্দিষ্ট বাড়িগুলোর কাজ শেষে হলে অন্য একটি বাড়িতেও কিছু কাজ করে দিতে হবে। ফিরে আসতে অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। সেই জন্য পাশের ঘরের জরিকে বলে যায় রেহানের দিকে একটু খেয়াল রাখতে। জরিকে প্রায় সময়ই বলে যায়। জরির বয়স নয় বছর। রেহানকে সে ছোট ভাইয়ের মতোই ভালোবাসে।

রোজিনা কাজ শেষ করে ফিরে আসতে কিছু দেরী হয়ে গেলো। এসেই দেখতে পেলো জরিদের ছোটো উঠোনে মানুষের ভিড়। বুকটা মুচড় দিয়ে ওঠে । রেহানের কী কিছু হলো ! মায়ের মন। অজানা আশংকায় কেঁপে ওঠে বুক। উঠোনে যেতেই দেখে ভিড়ের মধ্যে রেহান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একটি চাটাইয়ে জরির নিথর দেহ। দু’পা বেয়ে বেয়ে এখনও নামছে তাজা রক্ত। অনেকের মতো রোজিনাও বাকরুদ্ধ।একসময় পুলিশ এসে জরির লাশ নিয়ে গেলো।

মর্গ থেকে জরির লাশ নিয়ে আসা হয়েছে। জরির কাটাচেরা দেহের পাশে মায়ের হাত ধরে রেহানও দাঁড়িয়ে আছে। পকেট থেকে একটি ললিপপ বের করে জরিকে বলছে জরি আপু এই নাও ললিপপ।ওঠো। কথা বলো। সবার চোখ ছলছল করছে।রেহানের কথা শোনে রোজিনা চমকে ওঠে। রেহান ললিপপ পেলো কোথায় ! রোজিনা ছলছল নয়নে রেহানকে জিজ্ঞাসা করলো রেহান। এই সুইট কোথায় পেয়েছিস?

রেহান বল্ল: মা, কাল দীপন চাচা দুটো সুইট দিয়ে বললেন, রাস্তার পাশে গিয়ে খেলা করতে। আমি জরি আপুর কাছ থেকে যেতে চাইনি। আামাকে জোর করে যেতে বাধ্য করেছেন। আমি ভয়ে চলে যাই। দীপন চাচা জরিপুকে জোর করে ঘরের পেছনে নিয়ে যান। আমি জরি আপুর চিৎকার শোনেছি। কথাগুলো বলতে বলতে রেহানের চোখে জল নেমে এলো। ঐ সময় জরি কেন চিৎকার করেছিল, শিশু রেহান না বুঝলেও উপস্থিত সবাই বুঝে গেলেন এটা দীপনের কাজ। দীপনই জরিকে জোর করে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। রেহানের বলা কথাগুলো দীপন শোনে ফেলে। রেহানের ওপর দীপনের খুব রাগ হলো। প্রতিশোধের জন্য মরিয়া ওঠে। কারণ রেহানের সাক্ষ ̈ দীপনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।


ঈদের আর মাত্র দুইদিন বাকি। ইতোমধ্য রেহান, মা-কে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয় কেনাকাটার কথা। রোজিনা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলে, কাল-ই বাজারে যাবো আর তোমার জন্য একটা সুন্দর শার্ট, একটা জিন্সের পেন্ট আর সাদা একজোড়া জুতা কিনে দেব বাবা। সেমাই, মিস্টিও নিয়ে আসবো। মায়ের কথা শোনে রেহান খুব খুশি হল। রোজিনা টাকা জমা করে রাখা বৈয়ামটা আরও একবার বের করে দেখে নেয়। চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটে ওঠে। গতবছর অসুখের জন্য টাকা জমাতে পারেনি।ছেলেকে কিছু কিনে দিতে পারেনি। ছেলের ম্লান মুখ এখনও চোখে ভাসে। বড় কষ্ট হয়।


আজ কাজ শেষ করে সবাইকে বলে এসেছে কাল কাজে আসতে পারবে না। কাল ছেলের জন্য শপিং করবে। নতুন শার্ট পেন্ট আর জুতা পরলে ছেলেকে রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগবে। কল্পনা করে নিজেকে অনেক সুখি মনে করে রোজিনা। শপিং শব্দ নিজের মুখে উচ্চারণ শোনে নিজের থেকেই জরিনার ভেতর এক অদ্ভুত অনুভুতির সৃষ্টি হলো।

কাজ শেষ করে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কিন্তু রেহানকে কোথাও দেখতে পেলো না। কোথাও খেলছে ভেবে নাম ধরে কিছুক্ষণ ডাকাডকি করলো। কোনও সাড়া পেলো না। এদিক ওদিক কোথাও খুঁজে না পেয়ে আশপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করলো। কেউ বলতে পারছে না। যাদের সাথে খেলা করে কেউ কিছু বলতে পারলো না। রোজিনা পাগলের মত রেহানকে খুঁজতে লাগলো। অনেকেই তার সাথে রেহানকে খুঁজতে সাহায্য করছে। রোজিনার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। হার্টবিট বেড়েই চলেছে। চোখের জল গাল বেয়ে বেয়ে নামছে। রেহানকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অনেকদুর বড় রাস্তার পাশে ধানখেতের পাশে পড়ে থাকা রেহানের নিথর দেহ পাওয়া যায়। ছেলেকে জড়িয়ে রোজিনা অজ্ঞান হয়ে যায়। পানির ঝাপটা দিতে দিতে অবশেষে রোজিনার জ্ঞান ফেরে। সবাই ধরাধরি করে রেহানের নিথরদেহ নিয়ে আসে। পুলিশকে খবর দেয়া হয়।


পোস্টমোর্টেমের রিপোর্টে শ্বাসরোধই মৃতু ̈র কারণ বলা হয়েছে। রেহানের গলা ফুলে গেছে। ছেলের লাশের ওপর রোজিনা বার বার মুর্ছা যাচ্ছে। সবার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে নামছে। কয়েয়েকজন মহিলা রোজিনাকে জড়িয়ে রেহানের লাশের পাশ থেকে ঘরে নিয়ে গেলেন। রেহানের লাশ গোসল করানোর ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল কাফনের কাপড়ের ব্যাবস্থা কি আছে? রোজিনা উঠে দাঁড়ায়, পাগলিনীর মতো ধীরে ধীরে সেই বৈয়াম নিয়ে আসে। যে বৈয়ামে ছেলের জন্য ঈদে নুতন শার্ট, পেন্ট খরিদ করার জন্য টাকা জমা করছিল। বৈয়াম ভেঙে নয়শ’পঁচিশ টাকা পাওয়া গেলো।রোজিনা এই টাকা দিয়ে কাফনের ব্যাস্থা করে দিতে বলেই আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।


২৬ মে ২০১৯


0 Comments: