Headlines
Loading...
এ কে এম আব্দুল্লাহ’র গল্প: হিরো

এ কে এম আব্দুল্লাহ’র গল্প: হিরো





গল্পঃ হিরো                    

এ কে এম আব্দুল্লাহ



আকাশের গেইট যেন ভেঙে গ্যাছে। অনবরত ঝরছে বৃষ্টি।চারদিকে থৈ থৈ জল। খেত খামার, বস্তি ভেসে গ্যাছে এই বন্যার জলে। সর্বান্ত হারা মানুষ, জলের তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিয়েছে এই বিশাল এলাকার একমাত্র বেড়িবাঁধের ওপর। মাথার উপর খোলা আকাশ। বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষন নেই যেন। জলের গতি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ঝড় আর বৃষ্টিতে মানুষগুলো শ্বাস নিতে বড় কষ্ট হচ্ছে।একমাত্র আশ্রয়স্থল এই একটি বেড়িবাঁধ।এখানে আশ্রয় নেয়া মানুষের জায়গা যেমন কম,তেমনি আশ্রিত মানুষের তুলনায় সাহায্যের পরিমাণ ও অপর্যাপ্ত। মাঝে মধ্যে হ্যালিকাপ্টারে করে ছোটো ছোটো কিছু খাবারের প্যাকেট আসে। যা তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া ভিড়ের মধ্যে হুড়মুড় করার কারণে অনেকেই বঞ্চিত হয়। বেড়িবাঁধের ওপর ; যে,যেভাবে পারছে নিজের জায়গা করার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ পলিথিন দিয়ে মাথার উপর ছাদ বানাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিশুরা তাদের মতো করে খেলার চেষ্টা করছে। সকালে প্রথম যে সাহায্য এসেছে,তা থেকে যারা সংগ্রহ করতে পেরেছে— তারা কেউ কেউ রান্না করার চেষ্টায় ব্যাস্ত। গত দু’দিন বড় কষ্টে গেছে।কোনও সাহায্য আসেনি। আজ সকালে হ্যালিকাপ্টার থেকে যখন নিচের দিকে খাবারের প্যাকেট ফেলা হয়েছিলো; সবাই প্যাকেট ধরতে লাফালাফি করছিলো,নারী পুরুষ ছোটো বড়ো সবাই। ক্ষুধার কাছে সবকিছুই যে ঝাপসা হয়ে যায়। কারও কোনও দিকে খেয়াল থাকে না। লাফালাফিতে হিরো ও এসেছে। সেও বড়োদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উপর থেকে ফেলে দেওয়া প্যাকেট ধরার অনেক চেষ্ঠা করছে। ব্যার্থ হয়েছে বার বার। একসময় ভিড়ের ভেতর একটি প্যাকেটি নিচে পড়ে যায়। আর হিরো সে প্যাকেট পেয়ে যায়।তার চোখে মুখে খুশিতে ফোলে ওঠে।


হিরো। পুরোনাম বেলাল আহমদ। বয়স এগারো। তার ছোটো এক ভাই আছে। নাম হেলাল  আহমদ। বয়স ছয়-সাত বছর হবে। বন্যার আগে যখন তারা বস্তিতে ছিলো; তখন হিরো লুকিয়ে লুকিয়ে ছলিম ব্যাপারির বাসায় টেলিভিশন দেখতো। একদিন জ্যাকি শ্রফের অভিনিত হিন্দি ছবি ‘হিরো’ দ্যেখে।এরপর একটা রুমাল গলায় জড়িয়ে তার ভাই হেলাল ও হেলালের বয়সি সবাইকে ডেকে এনে বলে,এই সবাই শোনো ; তোমরা সবাই আমাকে আজ থেকে হিরো বলে ডাকবা। হিরোর কথা শোনে ভাঙা দাঁত বের করে হেলাল সহ সবাই খিল খিল করে হেসে ওঠে। বেলাল উরফে হিরো হেলালকে ক্যারাটে ষ্টাইলে,চাইনিজ ভাষায় ইয়া-উঁ বলে হাত পা নাড়াতে থাকে।সেই থেকে বেলাল হোসেন তাদের হিরো। হিরোও রিলিফের ঐ প্যাকেট মা’কে দিয়ে বলল মা,একটু জলদি করে রান্না করো,অনেকদিন হলো পেটভরে খাইনি। কোথাও থেকে তিনটুকরো আধলা ইটেরও ব্যবস্থাও  করে দিয়েছে। মা, জলে ভেসে আসা গাছের আধভেজা ডালে আগুন ধরানোর ব্যার্থ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন।হিরো যখন খাবারের প্যাকেট নিয়ে আসে এবং কায়দা করে যখন মার হাতে দ্যায়, সে দৃশ্য দেখে সে যেন সত্যিকারের হিরো এটা তার ভাই হেলাল বিশ্বাস করতে শুরু করল। 



জল এখন বাঁধের ছাদ ছুঁই ছুঁই। আশ্রিত মানুষের উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। হঠাৎ করে দূর থেকে হ্যালিকাপ্টারের আওয়াজ শোনা গ্যালো। সকলের কান খাড়া হলো। হয়ত খাবার নিয়ে আসছে। সাহায্য নিয়ে আসছে। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সকালে বন্যাকবলিত মানুষের বিপন্নজীবন নিয়ে একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জরুরী ভিত্তিতে আবার খাবার নিয়ে একটি হ্যালিকাপ্টার আসছে।ধীরে ধীরে আওয়াজ স্পষ্ট হতে লাগলো। সবাই সবকিছু ফেলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। হ্যালিকাপ্টারটি অনেকটা নিচে এলে,সবাই জড় হতে লাগলো। ভিড়ের ভেতর হ্যালিকাপ্টার থেকে খাবারের প্যাকেট নিচে ছুঁড়া হলে;  সকলের হাত উপর দিকে তুলে খাবারের প্যাকেট ক্রিকেট বলের মত ধরার চেষ্ঠা করতে লাগলো। কার ঠেলায় কে কোথায় পড়ছে কোনো খেয়াল নেই কারোরই। হিরো আর তার ভাই হেলাল মার পাশে বসা ছিল।হিরো বল্লঃ মা, রান্না শেষ করো। আমি আরও কিছু নিয়ে আসি বলে দৌড় দিয়ে গেলো ভিড়ের কাছে।  চিপায় চাপায় ঠেলা ধক্কা দিয়ে ভিড়ের ভেতর চলে এলো। সবার মতো সে ও লাফিয়ে লাফিয়ে খাবারের প্যাকেট ধরার ব্যার্থ চেষ্ঠা করছে।প্যাকেট নিচে এলেই কাড়া-কাড়ি শুরু হয়। কারও প্রতি কারোরই কানো খেয়াল নেই।একসময় হ্যালিকাপ্টার চলে যায়। যার ভাগ্যে যা জুটেছে তাই নিয়ে সবাই ফিরে যায় ।যারা বেশি ধরতে পেরেছে,তাদের মুখে কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে।



নিভু নিভু আগুনে চাল ডাল স্বেদ্ধ করেছেন হিরোর মা। অপেক্ষা করছেন হিরোর।দুই ছেলেকে নিয়ে খাবেন।  সবাই ফিরে এসেছে কিন্তু হিরো এখনও ফিরেনি। মা হেলালকে বললেন যা’তো তোদের হিরোকে ডেকে নিয়া আয়।খাবার হয়ে গ্যাছে। মা’র কথায় হেলাল হিরোকে ডাকে। কিন্তু কোথাও হিরোকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। মা ডাকাডাকি করতে লাগলেন। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। হেলাল আর তার মায়ের ডাকা-ডাকিতে বাঁধের উপর সবাই জড় হয়ে হিরোকে খুঁজতে লাগলো।হিরোর বয়সি কালাম বল্ল,হিরোকে খাবারের প্যাকেটের জন্য লাফাতে দেখেছে। সবাই  বাঁধের ঐ জায়গায় গিয়ে হিরোকে খুঁজতে গেলেন,যেখানে কিছুসময় আগে হ্যালিকাপ্টার ত্রাণ দিতে এসেছিলো।

হঠাৎ হেলাল চিৎকার করে বলে, ওই যে আমাদের হিরো।হাত দিয়ে ইশারা করে দেখায়। সবাই ওই দিকে তাকান। দেখতে পান— জলের ওপর উপুড় হয়ে ভাসছে হিরোর নিথর দেহ।   



0 Comments: